২০১৫ সালের দিকে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কর্মময় জীবন নিয়ে আলাপ করতে আমরা উনার ইন্টারভিউ করব ভাবছিলাম । ভাবছিলাম ইন্টারভিউর সময় প্রশ্ন বা আলাপের পরম্পরা আলোচনাকে এইদিক ঐদিক নানান দিকে নিয়ে যায় । আলাপকে গভীরতা কিনবা হালকা করে দেয় । অনেক সময় সাক্ষাৎকারের মধ্যদিয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট তৈয়ার হয় । ইতিহাস লেখা হয় । ফলে আমরা চাচ্ছিলাম ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাজ সম্পর্কে যিনি গভীর ভাবে জানেন-বুঝেন তেমন কেউ তার সাক্ষাৎকার নেক ।
বিষয়টা নিয়ে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে শেয়ার করতেই উনি এক বাক্যে ফরহাদ মজহারের কথা বললেন । বললেন, ‘ফরহাদ হইলে ভাল হয়’ । আমরা ফরহাদ ভাইকে অনুরোধ করলাম । উনি রাজি হইলেন ।
২০১৫ সালের ৭ আগস্ট শুক্রবার সকালে আমরা ইন্টারভিউ রেকর্ড করতে ক্যামেরা নিয়ে উনার ঢাকার ধানমন্ডির বাসায় হাজির হই ।
আলাপ শুরু হয় উনার আর্লি জীবনে দেশ-সমাজ-রাজনীতি-মানুষ সম্পর্কে কি করে ভাবতেন সেই প্রশ্ন দিয়ে । আলাপের প্রথম পর্বে উঠে আসে উনার পুলিশ অফিসার বাবার কথা, প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠার গল্প এবং গণ আন্দোলনের পক্ষে তখনকার ছাত্র সংসদের ভূমিকা ইত্যাদির কথা ।
জাফরুল্লাহ ৭১ এ যুদ্ধ শুরুর পরে ফাইনাল পরীক্ষার একসপ্তাহ আগে আগে লন্ডন থেকে চলে আসেন মুক্তিযুদ্ধে জয়েন করতে । নিজেদের উদ্যোগে ভারত সীমান্তে গড়ে তুলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হসপিটাল । জাফরুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলছিলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের বড় অংশ স্বাধীনভাবে নিজেদের শক্তিতেই ফাইট করতে চেয়েছেন ।
জেনারেল ওসমানী, তাজউদ্দীন, খালেদ মোশাররফ, জিয়াকে নিয়ে কথা বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বহু লোকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা আলাপ করতে যেয়ে বিশেষ ভাবে বলেছেন আবু সাঈদ চৌধুরী এবং সুভাষ বসুর দেহরক্ষীর কথা । সুভাষ চন্দ্র বসুর দেহরক্ষী হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানেই স্থাপিত হইয়েছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’।
পাকিস্তানীরা শেখ সাহেবকে ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছিলেন । পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে তখন ব্রিটেনে থাকা বাঙ্গালী আবু সাঈদ চৌধুরী যে ব্রিটিশ সরকারকে দিয়ে চাপ দিয়ে শেখ সাহেবের ফাঁসি ঠেকিয়েছেন সেই ইতিহাস বলেছেন । শেখ সাহেবকে আন্তরিক ভাবে কৃতিত্ব দেয়ার পাশাপাশি অন্যদের অবদান কেন আজকে বলা হয় না সেইসবের নেগেটিভ রাজনীতি এবং এই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ।
মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ের মধ্যেই কিভাবে বাংলাদেশের প্রাইমারী হেলথের ধারনা এবং অভিজ্ঞতা তৈয়ার হয় সেই কথা বলতে যেয়ে বলছিলেন, কর্পোরেট বিজ্ঞান-ব্যবসা-জ্ঞান কিভাবে মিস্ট্রি তৈয়ার করে-অতি মুনাফা কামায় । গরীবদের বিরুদ্ধে কাজ করে । সেইসবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে গণস্বাস্থ্য গড়ে উঠে ।
পড়া লেখা না জানা কমরেড সিরাজ শিকদারের বউ রাবেয়া খাতুন রুনোর গণস্বাস্থ্যে কাজের অভিজ্ঞতা কিভাবে সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল সেই গল্প বলে গণস্বাস্থ্য কিভাবে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় স্বাস্থ্যখাতে নতুন অভিজ্ঞতা এবং ধারনা হিসাবে ধীরে ধীরে হাজির হয় সেইসব অসাধারন অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেন জাফরুল্লাহ ।
স্বৈরাচার এরশাদকে দিয়ে ঔষধনীতি করাতে যেয়ে যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কৌশলী লড়াই করতে হয়েছিল সেই আলাপ সত্যিই বিস্ময়কর ।
৮০ দশক পর্যন্ত ভেজাল ঔষধে বাজার ভরা, সকল নাগরিকের জন্য বাংলাদেশে নিরাপদ ঔষধ না থাকা, ঔষধের দাম ছিল ৫/১০ গুণ বেশি ইত্যাদি আলাপ শুনতে শুনতে আপনি ঢুকে যাবেন রাজনীতি, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্র পরস্পর কিভাবে যুক্ত তার রাজনৈতিক-দার্শনিক আলাপে। যেই চিন্তা এখনো আমাদের বৃহৎ সমাজে পরিষ্কার হয়ে উঠে নাই । আগামী দিনে আমাদের সমাজ গঠনে এইসব আলাপ কাজে লাগবে ।
আশা করি প্রতিভাবান এবং লড়াকু দুইজন মানুষের এই আলাপ আমাদের সামগ্রিক ইতিহাস লিখনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে । বানানের পক্ষ থেকে উনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। পাঠক দুই ঘণ্টার ভিডিওটি দেইখেন ।
✍ মোহাম্মদ রোমেল, সম্পাদক ।